বাংলাদেশ সৃষ্টির এক ঐতিহাসিক স্থান “রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান” ; ঢাকা, বাংলাদেশ।

“ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান এর ইতিহাস”

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি সুপরিসর নগর উদ্যান। এটি পূর্বে রমনা রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। এক সময় ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাব এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে এটি রমনা রেস কোর্স এবং তারপর রমনা জিমখানা হিসাবে ডাকা হত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর মাঠটিকে কখনও কখনও ঢাকা রেস কোর্স নামে ডাকা হত এবং প্রতি রবিবার বৈধ “ঘোড়া দৌড়” প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রমনা রেসকোর্স নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

 
ছবিঃ  সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

রেসকোর্স ময়দান তথা সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান একটি জাতীয় স্মৃতিচিহ্নও বটে কেননা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭মার্চের ভাষণ এখানেই প্রদান করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বার পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই উদ্যানেই আত্মসমর্পণ করে মিত্র বাহিনীর কাছে। রেসকোর্স ময়দানের অদূরে অবস্থিত তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান হিসেবে প্রথমে নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীকালে আত্মসমর্পণের জন্য এই মাঠটি নির্বাচন করা হয়। রমনা রেসকোর্স ময়দানের দক্ষিণে রমনা কালী মন্দির, পুরানো হাইকোর্ট ভবন, হাজী শাহাবাজের মাজার ও মসজিদ  এবং তিন নেতার মাজার; পশ্চিমে বাংলা একাডেমী, অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, চারুকলা ইনস্টিটিউট; উত্তরে বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা ক্লাব ঢাকার টেনিস কমপ্লেক্স এবং পূর্বে সুপ্রীম কোর্ট ভবন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ও রমনা পার্ক অবস্থিত। 

 

ছবিঃ  সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে বিতর্ক চলছে। সরকার বলছে, ঐতিহাসিক এই মাঠের পরিকল্পিত সবুজায়নের অংশ হিসাবে 'অপ্রয়োজনীয়' গাছ কাটা হয়েছে, যার বদলে কয়েকগুণ বেশি গাছ লাগানো হবে। স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের অংশ হিসাবে এসব গাছ কাটার পরিকল্পনা করা হয়। তবে এসব গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশও হয়েছে।

 
ছবিঃ  সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটা বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

তাদের দাবি, ঢাকা শহরে সবুজ স্থান প্রয়োজনের তুলনায় কম, এসব গাছ কেটে ঢাকার সবুজ প্রকৃতি নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। বিক্ষোভের মুখে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী আপাতত গাছ কাটা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এটি শুধুমাত্র সাধারণ কোন উদ্যান বা মাঠ নয়, ঢাকার কেন্দ্রস্থলে এই উদ্যানটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কয়েকশো বছরের ইতিহাস।

 
ছবিঃ সবুজের প্রকৃতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

চারশো বছরের পুরনো উদ্যানঃ

বাংলাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে এই উদ্যানটি এখন পরিচিত হলেও এর ইতিহাসে একাধিকবার এর নাম পরিবর্তন হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, এই উদ্যানের জন্ম হয় আসলে মুঘল আমলে। ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী বইয়ে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ''সেই মুঘল আমল (১৬১০) থেকেই বিশেষ এলাকা হিসাবে রমনার ইতিহাসের শুরু। সময় বর্তমান নীলক্ষেত অঞ্চলে মহল্লা চিশতিয়ান এবং মহল্লা শুজাতপুর নামে গড়ে উঠেছিল দুটি আবাসিক এলাকা“ শুজাতপুর ছিল বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে বাংলা একাডেমী পর্যন্ত। পুরনো রেসকোর্সের দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল চিশতিয়া। পুরো এলাকাটি ছিল মৌজা শুজাতপুরের অন্তর্গত। মৌজা শুজাতপুর নাম হয়েছিল রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম খান চিশতীর ভাই শুজাত খান চিশতীর নামে। ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ''তাইফুর জানিয়েছেন, পুরনো হাইকোর্ট ভবন থেকে নিয়ে বর্তমান সড়ক ভবন পর্যন্ত মুঘলরা তৈরি করেছিলেন বাগান, যার নাম ছিল 'বাগ--বাদশাহী' বা 'বাদশাহী বাগান' ইতিহাসবিদরা মনে করেন, সেই সময় রমনা ছিল বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সড়ক ভবন পর্যন্ত সাজানো বাদশাহী বাগান। এর বাইরে বর্তমানে যেখানে কলাভবন, কার্জন হল রয়েছে, সেখানে মুঘলদের বেশ কিছু বাড়িঘর ছিল। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ''এই দুইটি এলাকা বাদশাহী বাগের মাঝখানের জায়গাটুকু (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জুড়ে ছিল সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বর। বিস্তৃত চত্বরের নাম হয়তো হয়ে গিয়েছিল রমনা। ফার্সি রমনার অর্থ সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বর, ইংরেজিতে 'ন। পরবর্তীকালে শুজাতপুর, চিশতিয়া, বাগ--বাদশাহী নাম বিলুপ্ত হয়ে গেলেও রমনা নামটি গিয়েছিল টিকে, আর নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকাটি।'' মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর ঢাকার অনেক অঞ্চল পরিণত হয়েছিল বিরান অঞ্চলে। অযত্নে-অবহেলায় রমনাও হয়ে পড়েছিল জঙ্গলাকীর্ণ।

 ছবিঃ রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান পুরনো ছবি।
ছবিঃ হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী।
 

কোম্পানি আমলে রমনার পরিবর্তনঃ

ইংরেজ আমলে রমনা পুনরুদ্ধারে প্রথম হাত দিয়েছিলেন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস 'স। ১৮২৫ সালে তিনি জেলখানার কয়েদিদের নিয়ে রমনা পরিষ্কারের কাজ শুরু করেন। তিনমাস চেষ্টার পর জঙ্গল পরিষ্কার করে তিনি ডিম্বাকৃতি একটি এলাকা বের করে আনেন। সেটার চারদিকে কাঠের রেলিং দিয়ে মি. ' তৈরি করেছিলেন রেসকোর্স ময়দান। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণের মতো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানমুনতাসীর মামুন লিখেছেন, মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য ' রেসকোর্সের উত্তর-পূর্ব দিকে তৈরি করেছিলেন একটি রাস্তা (বর্তমান নজরুল এভেনিউ)। তবে চার্লস ' ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর রমনা আবার গাছপালায় ভরে ওঠে। ১৮৪০ সালের দিকে রাসেল মোরল্যান্ড স্কিনার ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন। সেই সময় আবার রমনার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হতে শুরু করে। তখন অনেকে রমনার উত্তরাংশে বাগানবাড়ী তৈরি করতে শুরু করেন। ১৮৫৯ সালের সার্ভেয়ার জেনারেলের তৈরি ঢাকার মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, রমনাকে ভাগ করা হয়েছে দুইভাবে-রেসকোর্স আর বাকি অংশ টুকু রমনা প্লেইনস। পরবর্তীকালে নবাব আহসানউল্লাহ এখানে একটি চিড়িয়াখানাও স্থাপন করেছিলেন। নবাববাড়ির নাম ছিল এশরাত মঞ্জিল আর পুরো এলাকাটির নাম দিয়েছিলেন তারা শাহবাগ। একদিকে শাহবাগ, অন্যদিকে রেসকোর্স। নবাবরা এটিও পরিচালনা করতেন। নগরবাসীর এক অন্যতম বিনোদন ছিল ঘোড়দৌড় দেখা। রমনা এলাকার আলাদা চাকচিক্য তৈরি হয় ১৯০৬ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ করা হয়। সেই সময় বাংলা আসামকে নিয়ে গঠিত এলাকার প্রাদেশিক রাজধানী করা হয়েছিল ঢাকাকে। সেই এলাকার নাম দেয়া হয়েছিল রমনা সিভিল স্টেশন।

 
ছবিঃ রমনা রেসকোর্স ময়দান তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পরিবর্তিত ছবি।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর লিখেছেন, এখানে তৈরি করা হয়েছিল লাটভবন (পুরনো হাইকোর্ট), কার্জন হল, সচিবালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরনো বিল্ডিং, হাইকোর্ট ভবন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভবন, চামেরি ভবন, সরকারি কর্মচারীদের আবাস স্থল হিসাবে মিন্টো রোড, হেয়ার রোড আর নীলক্ষেতের লাল রঙের বাড়িঘর। সেই সময়ই রমনা পার্কেরও পত্তন করা হয়। রমনা এলাকা তখন মোটামুটি তিনভাবে বিভক্ত-রমনা সিভিল স্টেশন, রমনা পার্ক আর রেসকোর্স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা বইয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর রমনায় নবাব এস্টেটের দান করা জমি এবং সরকারি ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। কার্জন হল, পুরনো ঢাকা কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মূল ভবন, যা পূর্ববঙ্গ আসাম প্রদেশ গঠনের সময় তৈরি হয়েছিল, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করতে দেয়া হয়। এছাড়া মিন্টো রোডের লাল বিল্ডিংগুলো, যেখানে এখন মন্ত্রীরা ছিলেন, সেগুলো ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের আবাসস্থল।
 
                                    ছবিঃ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিন নেতার মাজার।
 

ইতিহাসের সাক্ষী রেসকোর্স ময়দানঃ

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দুইটি আলাদা দেশ হওয়ার পর রেসকোর্স ময়দান হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অনেক ঘটনার সাক্ষী। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ''পঞ্চাশ দশকের মধ্যেই রমনার বিস্তৃত ময়দানের সীমানা মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। রমনার মূল মাঠ পরিচিত হয়ে উঠেছিল রমনা রেসকোর্স হিসাবে, আরেক অংশ রমনা পার্ক হিসাবে।'' আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে ১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানেই তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। ওই দিনই তাকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করে ছাত্রজনতা। ১৯৭১ সালের তেসরা জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ময়দানে মহাসমাবেশের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। এর আগের বছরের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন, কোন অবস্থাতেই পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের চাপের মুখে তারা বাংলার মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। সাতই মার্চ এই ময়দানেই বিশাল সমাবেশে ভাষণ দেন শেখ মুজিবুর রহমান।

 
ছবিঃ রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ।

এই ময়দানেই ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে ফিরে এসে এই ময়দানেই ১০ই জানুয়ারি ভাষণ দেন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান। কিছুদিন পরে, ১৭ই মার্চ আরেকটি জনসভায় ভাষণ দেন শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি' যে গণআদালত গঠন করেছিল, সেই আদালতও বসেছিল এই উদ্যানেই।

ছবিঃ সোহরাওয়র্দী উদ্যানে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী
 
ছবিঃ সোহরাওয়র্দী উদ্যানে ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে 
'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি' গঠন।

 রেসকোর্স ময়দান থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানঃ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রমনা রেসকোর্স নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এরপর থেকে এই জায়গাটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামেই পরিচিত। ঢাকা শহরের কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অনেকটা খোলা জায়গা নিয়ে তৈরি হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে এই উদ্যানের খোলা অংশে গাছপালা লাগানো হয়। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে ময়দানের একটি অংশে তৈরি করা হয় শিশুপার্ক। স্বাধীনতার আগেই অবশ্য আরেকটি অংশে বর্তমানের ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের বর্তমান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (আইইবি) এর জন্য জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল।  তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এসে আবার ময়দানের সাথে জড়িত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৯ সালে ময়দানে 'শিখা চিরন্তন স্থাপন করা হয়। সেই সঙ্গে পাশেই যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে স্বাধীনতা স্তম্ভ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়।

২০১০ সালের সাতই জুলাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশের হাইকোর্ট সরকারের প্রতি নির্দেশনা সম্পর্কিত একটি রায় দিয়েছে। একটি কমিটির মাধ্যমে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে আন্তর্জাতিক মানের স্মৃতি সৌধ স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে -রায়ে। বর্তমানে এই উদ্যানের ঐতিহাসিক দিকগুলো তুলে ধরতে বাংলাদেশের সরকার তিনশো কোটি টাকার একটি প্রকল্প শুরু করেছে।

 

 
ছবিঃ সোহরাওয়র্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক দিক গুলো তুলে ধরতে সরকারের প্রকল্প।
 

ব্রিটিশ আমলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেমন ছিলঃ

১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার ব্রিটিশ কালেক্টর মি. ডয়েস ঢাকা নগরীর উন্নয়নকল্পে কতগুলি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তখন থেকেই ঢাকা আবার তার পুরানো গৌরব ফিরে পেতে শুরু করে। সময় কালেক্টর ডয়েস রমনা কালী মন্দির ছাড়া অন্যান্য বেশির ভাগ পুরানো স্থাপনা সরিয়ে ফেলেন এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে রমনাকে একটি পরিচ্ছন্ন এলাকার রূপ দেন। পুরানো হাইকোর্ট ভবনের পশ্চিমে বর্তমানে অবস্থিত মসজিদ এবং সমাধিগুলি তিনি অক্ষত রাখেন। পুরো এলাকাটি পরিষ্কার করে তিনি এর নাম দেন রমনা গ্রীন এবং এলাকাটিকে রেসকোর্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঠের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেন। রমনা কালী মন্দির হলো দশনামী গোত্রের হিন্দুদের কালী মন্দির। রমনা রেসকোর্সের মাঝখানে মন্দিরটি অবস্থিত ছিল। মনে করা হয় যে, নেপাল থেকে আগত দেবী কালীর একজন ভক্ত এই মন্দির নির্মাণ করেন। ঢাকা শহরের অন্যতম পুরানো এবং বনেদি এই কালী মন্দিরটি পরে ভাওয়ালের রানী বিলাসমণি দেবী সংস্কার উন্নয়ন করেন। 

নাজির হোসেন কিংবদন্তির ঢাকাগ্রন্থে লিখেছেন, "ব্রিটিশ আমলে রমনা ময়দানটি ঘোড়দৌড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। প্রতি শনিবার হতো ঘোড়দৌড়। এটা ছিল একই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসক সর্বস্তরের মানুষের চিত্তবিনোদনের একটি স্থান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক . শরীফ উদ্দিন আহমেদের এক বিবরণ থেকে জানা যায়, চার্লস ডজ রমনায় রেসকোর্স বা ঘোড়দৌড়ের মাঠ নির্মাণ করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকার খ্যাতনামা আলেম মুফতি দ্বীন মহম্মদ এক মাহফিল থেকে ঘৌড়দৌড়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। কারণে সরকার ১৯৪৯ সালে ঘৌড়দৌড় বন্ধ করে দেয়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামানুসারে রমনা রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করতঃ "সোহরাওয়ার্দী উদ্যান" রাখা হয়। ১৯৭০ দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে এখানে প্রচুর গাছ-গাছালি রোপণ করা হয়েছে। বর্তমানে ফাঁকা জায়গা তুলনামূলকভাবে কম। যদিও ছোটোখাটো বৈশাখী মেলা জাতীয় অনুষ্ঠানের পরিসর এখনো আছে কিন্তু কোনরূপ জনসভা করার অবকাশ আর নেই। এটি সময় কাটানো, হাঁটাহাটিঁ প্রভৃতির জন্য উপযুক্ত।

 

ছবিঃ সোহরাওয়ার্দীর উদ্যানের পুরনো ছবি।

ঢাকার নওয়াবদের আনুকূল্যে একসময় ঘোড়দৌড় ঢাকায় খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রাবাস মহসীন হলের উত্তরপাশে নওয়াবদের ঘোড়ার আস্তাবল কিছুদিন আগেও ছিল অক্ষত। ঢাকার নওয়াবগণ রেসকোর্স এলাকাটির উন্নয়ন সাধন করেন এবং এলাকায় একটি সুন্দর বাগান তৈরি করে তার নাম দেন শাহবাগ বা রাজকীয় বাগান। নওয়াবগণ এলাকাতে একটি চিড়িয়াখানাও স্থাপন করেছিলেন। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে রেসকোর্সের উত্তর কোণে ব্রিটিশ আমলারা ঢাকা ক্লাব স্থাপন করেন। পরে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের শাসনামলে বঙ্গভঙ্গের সময় পূর্ববঙ্গ আসাম নিয়ে নবগঠিত প্রদেশের গভর্নরের সরকারি বাসভবন স্থাপনের জন্যও রমনা এলাকাকে নির্বাচন করা হয়। এই গভর্নমেন্ট হাউজ পরে হাইকোর্ট ভবনে (পুরাতন) রূপান্তরিত হয়। গভর্নমেন্ট হাউজের পাশে মিন্টো রোড এলাকায় পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং হাইকোর্টের বিচারকদের বসবাসের জন্য বেশ কিছু সুন্দর উন্নতমানের ভবন তৈরি করা হয়। বৃহত্তর রমনা এলাকায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে এলাকাটির গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।

পাকিস্তান আমলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেমন ছিলঃ 

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পরও রমনা ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবেই থেকে যায়। শাহবাগ থেকে ইডেন বিল্ডিং (সচিবালয়) পর্যন্ত নতুন একটি রাস্তা করা হয় এবং এই রাস্তার পূর্বদিকের অংশে রমনা পার্ক নামে একটি চমৎকার বাগান গড়ে তোলা হয়। বর্তমানের সুপ্রীম কোর্ট ভবনের উত্তর-পূর্ব কোণের চিড়িয়াখানাটি তখনও বিদ্যমান ছিল। তবে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের মধ্যে ছিল শুধু গুটিকয়েক বাঘ, ভালুক এবং বিভিন্ন জাতের কিছু পাখি। পরে চিড়িয়াখানাটি মীরপুরে তার বর্তমান অবস্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে রমনা রেসকোর্সে তাকে এক নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া এবং এখানেই তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রমনা রেসকোর্সে এক মহাসমাবেশের আয়োজন করে এবং এই সমাবেশে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যগণ প্রকাশ্যভাবে জনসভায় শপথ গ্রহণ করেন যে, কোন অবস্থাতেই এমনকি পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের চাপের মুখেও তারা বাংলার মানুষের স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।


১৯৭১ সালের মার্চ আবার এই রমনাতে এক মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেনএবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রামএই ঘোষণার মাধ্যমে কার্যত বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করেন। মাস বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে এবং রমনা মাঠেই (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যগণ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই দিনটি বাংলাদেশের বিজয় দিবস। এই ঘটনার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য রাখেন। সময় থেকে রমনা রেসকোর্স গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমাবেশের স্থানে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা রমনায় গণহত্যাত সংঘটিত করে এবং রমনা কালী মন্দির ধ্বংস করে দেয়। ২০২১ সালে মন্দিরটি পুনঃনির্মিত হয়।

 
ছবিঃ রমনা  কালী মন্দির।

 উদ্যানের আকর্ষণীয় বিভিন্ন স্থাপনাঃ

“শিখা চিরন্তন”,  ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই স্থানটিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  তাঁর ঐতিহাসিক ০৭ মার্চের ভাষণ প্রদান করেন। ১৯৭৫ সালের পর এলাকাটিকে সবুজে ঘেরা পার্কে পরিণত করা হয়। পার্কের একপাশে শিশুদের জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্র তথা পার্ক গড়ে তোলা হয়। এখানে শিশুদের জন্য নানা ধরনের আকর্ষণীয় খেলাধুলা, খাবার রেস্তোরাঁ এবং ছোটখাটো স্মারক জিনিসপত্র ক্রয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।

 
ছবিঃ উদ্যানের দেয়ালে জাতীয় চার নেতার ভাস্কর্যমন্ডিত কারুকার্য।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংক্রান্ত যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলিকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে এখানে “শিখা চিরন্তন” স্থাপন করা হয়েছে এবং একইসাথে তার পাশেই যেখানে পাকিস্তানি সেনাগণ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে  স্বাধীনতা স্তম্ভ।

                                                             ছবিঃ শিখা চিরন্তন।

১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ  ক্ষমতায় এলে এখানে স্বাধীনতা স্তম্ভ শিখা চিরন্তন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রকল্পের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ জনতার দেয়াল  নামে ২৭৩ ফুট দীর্ঘ একটি দেয়ালচিত্র। এটি ইতিহাসভিত্তিক টেরাকোটার পৃথিবীর দীর্ঘতম ম্যুরাল। এর বিষয়বস্তু ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস। ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খনন করা হয়েছে একটি কৃত্রিম জলাশয় বা লেক। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে চারদলীয় জোট সরকার -এর শাসনামলে আমলে উদ্যানের ভেতর ঢাকা জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা সংবলিত একটি স্থাপনা তৈরি করা হয়  জনতার দেয়াল টেরাকোটা ম্যুরালের নিচের অংশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বাধীনত জাদুঘর। এখানে দেশের বৃহত্তম মুক্তমঞ্চ অবস্থিত, যেটি ২০১১ সালের মার্চ থেকে বিভিন্ন শিক্ষা সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে।

 

ছবিঃ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

স্বাধীনতা জাদুঘরঃ

স্বাধীনতা জাদুঘর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের অন্যতম স্থাপনা। এই জাদুঘর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস চিত্রিত করে। মুঘল শাসনামল থেকে শুরু করে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রাম-ইতিহাসের সচিত্র বর্ণনা প্রদর্শন করছে জাদুঘরটি। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ তার ঐতিহাসিক ভাষণ  প্রদান করেন এবং এখানেই একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীনতা জাদুঘর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ’স্বাধীনতা জাদুঘর’ বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর  এর এখতিয়ারে একটি শাখা জাদুঘর হিসাবে পরিচালিত।


                                                        ছবিঃ স্বাধীনতা জাদুঘর।

Previous Post Next Post
atOptions = { 'key' : 'ff715ba50c059c742bfea5af35b4aa55', 'format' : 'iframe', 'height' : 50, 'width' : 320, 'params' : {} };