“কার্জন হল” ইতিহাসের অমর সাক্ষী, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।

  

 কার্জন হল
 
উপমহাদেশের মধ্যে ব্রিটিশ স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন হলো বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল। এর সাথে জড়িয়ে বাংলদেশের প্রাচীন ইতিহাসও। সাত চল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের নীরব সাক্ষী এই স্থাপনাটি। কার্জন হল যেন এক মৌন ভাষা সৈনিক এবং মহান মুক্তিযোদ্ধা। 
 

স্থাপনাটি শুধুমাত্র একটি ইট-পাথরের ভবনই নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে এদেশের মানুষের আবেগ। কার্জন হলের ইতিহাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও পুরনো। অসাধারণ নির্মাণশৈলীর স্থাপনাটি যেকোনো ভাবুক ব্যক্তিকে দ্বিতীবার তাকিয়ে দেখতে বাধ্য করে। চলুন আজ আমরা কার্জন হলের সেকাল-একাল নিয়ে কিছু জানার চেষ্টা করব।

কার্জন হলের সাথে জড়িয়ে আছে বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস। ব্রিটিশ সরকার যখন বঙ্গভঙ্গ করার পরিকল্পনা করছিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা হওয়ার কথা ছিল পূর্ব বাংলার রাজধানী। তখন ঢাকায় তেমন কোনো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি স্থাপনা ছিল না। ঢাকার গুরুত্ব বুঝতে পেরে ব্রিটিশরা ঢাকাতে বেশ কিছু স্থাপনা নির্মিণের জন্য অনুমোদন করে। তার মধ্যে কার্জন হল অন্যতম।

বর্তমানে কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান জীববিজ্ঞান অনুষদের কিছু শ্রেণিকক্ষ পরীক্ষার হল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এটি নির্মাণ করা হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। তাছাড়া ১৯০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অস্ত্বিত্বই ছিল না।


ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ববিদ আহমাদ হাসান দানী লিখেছেন, “কার্জন হল নির্মিত হয়েছিল টাউন হল হিসেবে| কিন্তু শরীফ উদ্দীন আহমদ এক প্রবন্ধে বলেছেন, ধারণাটি ভুল। তার মতে এটি নির্মিত হয়েছিল ঢাকা কলেজের পাঠাগার হিসেবে। এবং নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করেন ভাওয়ালের রাজকুমার। ১৯০৪ সালের ঢাকা প্রকাশ লিখেছিল-

Òঢাকা কলেজ নিমতলীতে স্থানান্তরিত হইবে। এই কলেজের সংশ্রবে একটি পাঠাগার নির্মাণের জন্য সুযোগ্য প্রিন্সিপাল ডাক্তার রায় মহাশয় যত্নবান ছিলেন। বড়লাট বাহাদুরের আগমণ উপলক্ষ্যে ভাওয়ালের রাজকুমারগণ অঞ্চলে লর্ড কার্জন বাহাদুরের নাম চিরস্মরণীয় করিবার নিমিত্তেও  কার্জন হলনামে একটি সাধারণ পাঠাগার নির্মাণের জন্য দেড় লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন।Ó’

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে, ঢাকা কলেজের ক্লাস নেওয়া হতে থাকে কার্জন হলে। পরবর্তী সময়ে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে কার্জন হল অন্তর্ভুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের জন্য, যা আজ অবধি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

লর্ড কার্জনের ঢাকা আগমনঃ 
১৯০৪ সালে ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব বাংলা সফর করেন লর্ড কার্জন। বাংলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মতামত জানতে চান। ঢাকা তখন নিতান্তই একটি মফস্বল, বাংলার রাজধানী নয়। আয়তনেও খুব বেশি বড় ছিল না। তখন বুড়িগঙ্গার পাড় থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্তই ছিল ঢাকার বিস্তৃতি।

 

 ছবিঃ লর্ড কার্জন।

ট্রেনে চড়ে ভাইসরয় লর্ড কার্জন এবং লেডি কার্জন এসেছিলেন ঢাকায়। লর্ড কার্জনের আগমন উপলক্ষে সেদিন ঢাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যান্ড্রু হেন্ডারসন লেথ ফ্রেজার নিজ হাতে ফুলের মালা পরিয়ে লর্ড কার্জনকে সংবর্ধনা জানান। এরপর লর্ড কার্জনকে নিয়ে যাওয়া হয় রমনায়। ১৯০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি কার্জন হল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

লর্ড কার্জনের ঢাকা আগমন ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ঢাকার ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে ঘটনাটি বারবারই সামনে আসে। পিছিয়ে পড়া পূর্ব বাংলার মানুষ সেবারই সর্বপ্রথম কোনো ভাইসরয়ের সাক্ষাৎ পায়। লর্ড কার্জনের আগমনের পর থেকেই উপমহাদেশে ঢাকার ভাবমূর্তি এক অনন্য উচ্চতায় উঠে আসে। মাত্র দুÕবছর পরই বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ঢাকা পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

বঙ্গভঙ্গঃ 
কার্জন হলের সাথে জড়িয়ে আছে বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস। মূলত কার্জন হল নির্মিতই হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে¨ ১৯০৩ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ বিবেচনা করা হয়। তখন বঙ্গ হতে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ঢাকা ময়মনসিংহ জেলাকে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাবও ছিল।

১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে সরকারিভাবে পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়। এরপর ফেব্রুয়ারিতে লর্ড কার্জন বাংলার বিভিন্ন জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম ময়মনসিংহে সফর করে বিভক্তির বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দেন।

 

অবশেষে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। নতুন প্রদেশের নামকরণ করা হয়পূর্ব বঙ্গ আসাম, যার রাজধানী হবে ঢাকা। এর আয়তন নির্ধারিত হয় ,০৬,৫০৪ বর্গমাইল। মোট জনসংখ্যা দাঁড়ায় তিন কোটি ১০ লক্ষ। এর মধ্যে এক কোটি ৮০ লক্ষ ছিল মুসলিম এবং এক কোটি ২০ লক্ষ ছিল হিন্দু। ব্রিটিশ সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই। একই বছরের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়।

বঙ্গভঙ্গ কি?
আমরা জানি যে, ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, আর বঙ্গভঙ্গ তার আরও আগের ঘটনা, যেটি আমরা হয়েছিল ১৯০৫ সালে। বঙ্গভঙ্গ এই শব্দটি খেয়াল করবেন, বঙ্গ প্রদেশ কে ভঙ্গ বা ভাগ করা বিষয়টি কে নির্দেশ করছে। উল্লেখ্য যে, বঙ্গ প্রদেশ কে বাংলা প্রেসিডেন্সি বলা হতো।

১৯০৫ সালে, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক কারণ এর ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গ করা হয়। ১৯০৫ সালের সেপ্টেম্বর ভঙ্গভঙ্গ এর ঘোষণা দেয়া হয় এবং ১৫ অক্টোবর থেকে তা কার্যকর করা হয়। ঢাকা, রাজশাহী, চট্রগ্রাম, আসাম নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব বঙ্গ আসাম যার রাজধানী হয় ঢাকা। পশ্চিম বাংলা, বিহার উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিম বঙ্গ প্রদেশ যার রাজধানী হয় কলকাতা।

একটা কথা বলতেই হয় বঙ্গভঙ্গ এর ফলে মুসলমান জনগণ খুশি হলেও, হিন্দু জনগণেরা বঙ্গভঙ্গ কে সমর্থন করেন নি। যার কারণে পরবর্তীতে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়েছিল। 

অনন্য স্থাপত্যঃ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এলেই নাম চলে আসে ঐতিহাসিক কার্জন হলের। ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য হিসেবে বিবেচিত ভবনটিতে সংযোজিত হয়েছে ইউরোপ মুঘল স্থাপত্য রীতির দৃষ্টিনন্দন সংমিশ্রণ।

ঐতিহাসিক শিল্পের সিথে মিশ্রিত হয়েছে আধুনিক কারিগরি বিদ্যা। মুঘল ধাঁচের খিলান গম্বুজে প্রকাশ পায় পাশ্চাত্য ইসলামিক স্থাপত্য। ভবনটিতে সংযোজিত হয়েছে ইউরোপ মুঘল স্থাপত্য রীতির দৃষ্টিনন্দন সংমিশ্রণ। আংশিকভাবে মুসলিম স্থাপত্যরীতিও ফুটে উঠেছে। ভবনের বাইরের অংশে গাঢ় লাল রঙের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। কিছুটা দূর থেকে এর দৃষ্টিনন্দন খিলান গম্বুজগুলো দেখতে চমৎকার দেখায়।

 

কারুকার্য খচিত দৃষ্টিনন্দন ভবনে রয়েছে একটি বিশাল কেন্দ্রীয় হল। ভবনটির সামনে রয়েছে একটি প্রশস্ত বাগান, যেখানে সবুজের বুক চিরে পশ্চিম থেকে পূর্বে চলে গেছে একটি সরু রাস্তা। এর পেছনে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর, যার পশ্চিম পাড়ে শেরে বাংলা ফজলুল হক হলের মূল ভবন। দ্বিতল ভবন ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য হিসেবে বিবেচিত।

কার্জন হল লাল রঙ কেন?
কার্জনের রঙ লাল কেন? এমন প্রশ্ন শুনতে অবান্তর মনে হতে পারে। কিন্তু কার্জন হলের রঙ লাল হওয়ার পেছনে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। স্থাপনায় ইউরোপীয় মুঘল স্থাপত্যরীতির সম্মেলন ঘটেছে। মুঘল সম্রাট আকবরের ফতেহপুর সিক্রির দিওয়ান--খাসের অনুকরণে লাল বেলেপাথরের পরিবর্তে ব্রিটিশরা গাঢ় লাল ইট ব্যবহার করেছে। স্থাপনার মাধ্যমে ব্রিটিশরা প্রমাণ করতে চেয়েছে উপমহাদেশে তাদের অবস্থান আকবরের মতো। কেননা একমাত্র আকবরকেই তারা শ্রেষ্ঠ যোগ্য মুঘল শাসক হিসেবে স্বীকার করত।

আন্দোলন সংগ্রামে Òকার্জন হলÓ t

বাংলার প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সাক্ষী কার্জন হল। ভাষা আন্দোলনের জ্বলজ্বলে স্মৃতি নিয়ে কার্জন হল সাক্ষাৎ সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৪৮ সালে যখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এখানে ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তৎক্ষণাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ করে। ভাষা আন্দোলনের প্রারম্ভিক ইতিহাসের সাথে এভাবেই জড়িয়ে যায় কার্জন হলের নাম। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে হলের ভূমিকা অপরিসীম। সে সময়ে সকল আন্দোলন সংগ্রামের আতুঁড়ঘর ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ কার্জন হল। একইভাবে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও কার্জন হলের নাম স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা স্থাপত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অন্যান্য দর্শনার্থীর জন্যও একটি আকর্ষণীয় স্থান। ব্রিটিশ স্থাপত্যের স্বাদ নিতে প্রতিদিনই এখানে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায়। নানা ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের আড্ডা পদচারণায় স্থানটি মুখরিত থাকে। সারাক্ষণ প্রাণচঞ্চল থাকা ভবনের পাশেই রয়েছে ফজলুল হক মুসলিম হল শহীদুল্লাহ হল। মাঝে এক মনোরম পুকুর স্থাপত্যটিকে দিয়েছে আলাদা আকর্ষণ।

 


                                     ছবিঃ কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

                                           


 


Previous Post Next Post
atOptions = { 'key' : 'ff715ba50c059c742bfea5af35b4aa55', 'format' : 'iframe', 'height' : 50, 'width' : 320, 'params' : {} };