“আহসান মঞ্জিল” ঐতিহাসিক ও অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর একটি প্রাসাদ, ঢাকা, বাংলাদেশ।

 

 মনোমুগ্ধকর প্রাসাদ “আহসান মঞ্জিল”

“আহসান মঞ্জিল” ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে পুরান ঢাকার ইসলামপুর এলাকায় অবস্থিত। এটি তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের উপাধিপ্রাপ্ত বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নবাব পরিবারের বাসভবন সদর কাচারি ছিল। সুরম্য ভবনটি ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন। ঢাকা মহানগরীর উন্নয়ন রাজনৈতিক ক্রমবিকাশের বহু স্মরণীয় ঘটনাসহ অনেক জাতীয় আন্তর্জাতিক স্মৃতি বিজরিত এইআহসান মঞ্জিল

আহসান মঞ্জিলএর আদি ইতিহাসঃ

আহসান মঞ্জিল এর প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন। ১৮৫৯ সালে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ সালে সমাপ্ত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পথ শুরু আহসান মঞ্জিল থেকেই। এখান থেকেই ১৯০৬ সালে এক অনুষ্ঠিত বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়।  


অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জামালপুর পরগনার জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থান রঙমহল নামে একটি প্রমোদভবন তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে তার ছেলে শেখ মতিউল্লাহ রঙমহলটি ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। বাণিজ্য কুঠি হিসাবে এটি দীর্ঘ দিন পরিচিত ছিল। এরপর ১৮৩০ সালে বেগমবাজারে বসবাসকারী নওয়াব আবদুল গণির পিতা খাজা আলীমুল্লাহ এটি কিনে বসবাস শুরু করেন।  

এই বাসভবনকে কেন্দ্র করে খাজা আবদুল গণি মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি নামক একটি ইউরোপীয় নির্মাণ ইঞ্জিনিয়ারিং-প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেন। যার প্রধান ইমারত ছিল আহসান মঞ্জিল। ১৮৫৯ সালে নওয়াব আবদুল গণি প্রাসাদটি নির্মাণ শুরু করেন, যা ১৮৭২ সালে সমাপ্ত হয়। তিনি তার প্রিয় ছেলে খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেনআহসান মঞ্জিল ওই যুগে নবনির্মিত প্রাসাদ ভবনটি রঙমহল পুরাতন ভবনটি অন্দরমহল নামে পরিচিত ছিল।


জমিদারি উচ্ছেদ আইনে ১৯৫২ সালে ঢাকার নবাব এস্টেট সরকার অধিগ্রহণ করে। নবাব পরিবারের সম্পত্তির মধ্যে অধিগ্রহণ বহির্ভূত ছিল আহসান মঞ্জিল তৎসংলগ্ন আঙিনা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নবাব পরিবারের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা বিদেশে পাড়ি জমান। দেশে যাঁরা ছিলেন তাঁরা বিরাট এই প্রাসাদ ভবনের রক্ষণাবেক্ষণে সক্ষম ছিলেন না। ফলে এটি ক্রমাগত ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে। ১৯৭৪ সালে নবাব পরিবারের উত্তরসূরীরা আহসান মঞ্জিল নিলামে বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভবনটির  রাজনৈতিক ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে, ১৯৭৪ সালের নভেম্বর, প্রাসাদ ভবনটি নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। এরপর সংস্কার করে এখানে জাদুঘর পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দেন। ১৯৮৫ সালের নভেম্বর আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ তৎসংলগ্ন চত্বর সরকার অধিগ্রহণ করে সেখানে জাদুঘর স্থাপনের কাজ শুরু করে। ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

 

নব সৃজনে আহসান মঞ্জিলঃ

 

১৮৮৮ সালের এপ্রিল প্রবল ভূমিকম্পে পুরো আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ক্ষতিগ্রস্থ আহসান মঞ্জিল পুনঃনির্মাণের সময় বর্তমান উঁচু গম্বুজটি সংযোজন করা হয়। পুনর্নির্মাণ মেরামতের জন্য রাণীগঞ্জ থেকে উন্নতমানের ইট আনা হয়। মেরামতকার্য  পরিচালনা করেন ইঞ্জিনিয়ার গোবিন্দ চন্দ্র রায়। সেই আমলে ঢাকা শহরে আহসান মঞ্জিলের মতো এত জাঁকালো ভবন আর ছিল না। এর প্রাসাদপরি গম্বুজটি শহরের অন্যতম উঁচু চূড়া হওয়ায় তা বহুদূর থেকেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো।

 


 

 

দ্বিতীয় বারের মতো ১৮৯৭ সালে ১২ জুন ঢাকায় ভূমিকম্প আঘাত হানলে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। মঞ্জিলের দক্ষিণের বারান্দাসহ ইসলামপুর রোড সংলগ্ন নহবত খানাটি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। পরবর্তীকালে আবার নবাব আহসানুল্লাহ তা পুনঃনির্মাণ করেন। বর্তমানে আহসান মঞ্জিলের ৩১টি কক্ষের মধ্যে ২৩টি কক্ষ বিভিন্ন প্রর্দশনীর জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে। নয়টি কক্ষ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত এবং ফ্রিৎজ কাপ কর্তৃক ১৯০৪ সালে তোলা ছবির সাথে মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। আহসান মঞ্জিলের তোষাখানা ক্রোকারিজ কক্ষে থাকা তৈজসপত্র এবং নওয়াব এস্টেটের পুরনো অফিস এডওয়ার্ড হাউস থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ করে প্রদর্শন করা হয়েছে আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে।

 

আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য আছে নওয়াব আমলের ডাইনিং রুম, নওয়াবদের ব্যবহৃত বড় বড় আয়না, আলমারি, সিন্দুক, কাচ চিনামাটির থালাবাসন, নওয়াবদের অতি বিশ্বস্ত হাতির মাথার কঙ্কাল গজদন্তসহ, নওয়াব আমলের বিভিন্ন ধরনের অলংকৃত রুপা ক্রিস্টালের তৈরি চেয়ার-টেবিল, বিভিন্ন ধরনের তৈলচিত্র, ফুলদানি, আতরদানি, পানদান, নবাবদের ড্রয়িং রুম, নাচঘর, সোনা রুপার তারজালিকাজ আহসান মঞ্জিলের মডেল। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা মোট চার হাজার ৭৭টি।


প্রাসাদের বাইরের সোন্দর্যঃ

প্রাসাদের উত্তর দক্ষিণ দিকে একতলার সমান উঁচু করে গাড়ি বারান্দা। দক্ষিণ দিকের গাড়ি বারান্দার ওপর দিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে একটি সুবৃহৎ খোলা সিঁড়ি সম্মুখের বাগান দিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত নেমে গেছে। প্রাসাদের উভয় তলার উত্তর দক্ষিণ দিকে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার খিলানসহযোগে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা কক্ষগুলোর মেঝে মার্বেল পাথরে শোভিত।  


গম্বুজের সোন্দর্যে আহসান মঞ্জিল আলোকিতঃ

আহসান মঞ্জিলের গম্বুজটি নির্মাণের জন্য প্রথমে নিচতলার বর্গাকার কক্ষটির চারকোণায় ইট দিয়ে ভরাট করে গোলাকার রূপ দেওয়া হয়েছে। এর উপর দোতলায় নির্মিত অনুরূপ গোলাকার কক্ষের ঊর্ধ্বাংশে স্কুইঞ্চের মাধ্যমে ছাদের কাছে কক্ষটিকে অষ্টভূজাকৃতির করা হয়েছে। এই অষ্টকোণ কক্ষটিই ছাদের উপর গম্বুজের পিপায় পরিণত হয়েছে।  

পরিশেষে অষ্টবাহুর মাথাগুলোকে কেন্দ্রের দিকে ক্রমে হেলিয়ে চূড়াতে নিয়ে কুমদ্র কলির আকারের গম্বুজটি তৈরি করা হয়েছে। ভূমি থেকে গম্বুজ শীর্ষের উচ্চতা ২৭ দশমিক ১৩ মিটার। গম্বুজের সোন্দর্য দর্শনার্থীদের মন ছুঁয়ে যায়। আহসান মঞ্জিলের প্রতিটি কক্ষ ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়।

 

আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে প্রদর্শনী থেকে জানা যাবে নবাবদের অবদানে ঢাকায় কবে কিভাবে ফিল্টার করা সুপেয় পানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর আগে ঢাকায় ফিল্টার পানীয় জলের কোনো সুযোগ ছিল না। জনকল্যাণমনা নবাব আবদুল গনি আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে তখন ঢাকা শহরে ফিল্টার পানির কল স্থাপন করেন। নবাবদের অবদানে ঢাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯০১ সালের ডিসেম্বর তৎকালীন প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা ব্যয় করে ঢাকায় প্রথম বিজলি বাতির ব্যবস্থা করেন। এখান থেকে জানা যায় দেশে কখন কীভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার চালু হয়।

প্রতিদিন প্রায় হাজার খানেক দেশি-বিদেশি ভ্রমণপিয়াসি দর্শনার্থী আহসান মঞ্জিল ভ্রমণ করেন, তাদের ভ্রমণের তৃষ্ণা নিবারণ করেন। আর ভ্রমণ শেষে তাঁরা প্রশান্ত মনে ঐতিহাসিক জ্ঞান অর্জন করে ফিরে যান।

আহসান মঞ্জিল তথা জাদুঘর গ্রীষ্মকালে শনিবার থেকে বুধবার সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট এবং শীতকালে সকাল ৯টা ৩০মিনিট থেকে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকে, সব ঋতুতে শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বৃহস্পতিবার জাদুঘর সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। ছাড়া সব সরকারি ছুটির দিনেও জাদুঘর বন্ধ থাকে।

“আহসান মঞ্জিল” বাংলাদেশের ঢাকার ঐতিহাসিক ও অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর একটি প্রাসাদ। বর্তমানে প্রাসাদটি পরিদর্শন করার জন্য নিম্নের ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন।   

https://ahsanmanzilticket.gov.bd 

Previous Post Next Post
atOptions = { 'key' : 'ff715ba50c059c742bfea5af35b4aa55', 'format' : 'iframe', 'height' : 50, 'width' : 320, 'params' : {} };