৬০০ বছরেরও অধিক সময়ের কালের সাক্ষী এক অপরুপ স্থাপত্যশৈলী প্রাচীন নিদর্শন “ষাট গম্ভুজ মসজিদ”; সুন্দরঘোনা, বাগেরহাট, বাংলাদেশ।

 অপরুপ স্থাপত্যশৈলী প্রাচীন নিদর্শন “ষাট গম্ভুজ মসজিদ”; সুন্দরঘোনা, বাগেরহাট, বাংলাদেশ।

 

মুসলিম স্থাপত্যের প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে পরিচিত ষাট গম্বুজ মসজিদ। বাংলাদেশের বাগেরহাট শহরের সাত কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তর পাশে সুন্দরঘোনা গ্রামে ঐতিহ্যবাহী   মসজিদটির অবস্থান। মসজিদটির গায়ে কোন শিলালিপি না থাকায় এটি কে কখন নির্মাণ করেছিলেন সে সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কথিত রয়েছে, সুলতান নসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৫-৫৯) আমলে খান আল-আজম উলুগ খানজাহান বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে সুন্দরবনের কোলঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তুলছিলেন। এসময় তিনি ধর্মীয় দাওয়াত প্রদান কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন, যা পরে ষাট গম্বুজ মসজিদ হিসেবে পরিচিতি পায়।

 

আধুনিককালের ঐতিহাসিক লেনপুলের মতে, ১৮৭১ সালে আগাছার তলদেশ থেকে এই মসজিদ আবিষ্কার করা হয়। শুরুতে জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল মসজিদটি। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি একাধিকবার সংস্কার করার পর পোড়া লাল মাটির ওপর সুনিপুণ লতাপাতার অলংকরণসহ মসজিদের ভেতরে-বাইরে সৌন্দর্যের প্রকৃত রূপ ফুটে উঠেছে। বর্তমানে মসজিদে প্রায় আড়াই হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে ষাট গম্বুজ মসজিদসহ খানজাহানের স্থাপত্যগুলোকে তালিকাভুক্ত করে এবং ৬০০ বছর ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে প্রচীন নিদর্শন হিসেবে স্থান দেয়।

 

ঐতিহ্যবাহী মসজিদটিরষাটগম্বুজ মসজিদনামকরনের সঠিক ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, মসজিদটির ছাদ সমতল নয়। এটি গম্বুজ আকৃতির। অর্থাৎ ছাদে গম্বুজ। এর থেকে মসজিদটিছাদগুম্বজনামে পরিচিতি লাভ করে। পরে যা কথ্যরুপেষাটগুম্বজনাম হয়েছে। আবার কারও মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ছয়টি সারিতে দশটি করে মোট ষাটটি পাথরের খাম্বার উপর মসজিদের ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ। তবে নাম যাই হোক ছয় শতাব্দীর অধিক কাল ধরে এই মসজিদটি বাগেরহাট সহ দেশ বিদেশের অনেকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।

মসজিদটির নির্মান নিয়ে জনশ্রুতি আছে যে, হজরত খানজাহান আলী (রহ.) ষাট গম্বুজ মসজিদ নির্মাণের জন্য সমুদয় পাথর তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলে সুদূর চট্টগ্রাম, মতান্তরে ভারতের ওডিশার রাজমহল থেকে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। এছাড়া, ইমারতটির গঠনবৈচিত্র্যে তুঘলক স্থাপত্যেরও বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মসজিদটি বাহিরে থেকে দেখলে এক অসাধারণ সৌন্দর্য পরিলক্ষিত হয়ে এবং মসজিদের ভেতর প্রবেশ করলে ধর্মীয় শান্ত এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ অনুভূত হয়। 

 

এদিকে মসজিদটি ষাটগুম্বজ নামে পরিচিত হলেও এতে মোট গম্বুজ আছে ৮১ টি। এদের মধ্যে সাত লাইনে ১১ টি করে ৭৭ টি এবং চার কোনায় টি ৪টি গম্বুজ অবিস্থিত। দৃষ্টিনন্দনি এই মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। মসজিদের প্রতটি দেয়াল প্রায় ফুট পুরু। ষাট গম্বুজ মসজিদে গম্বুজের সংখ্যা মোট ৮১ টি, সাত লাইনে ১১ টি করে ৭৭ টি এবং চার কোনায় টি মোট ৮১ টি। গবেষকরা বলছেন, জলবায়ুর ক্ষতি থেকে মসজিদটি রক্ষায় স্তম্ভের নিচে চার ফুট পর্যন্ত পাথরের আস্তরণ দেওয়া হয়েছে।

 

হযরত খান জাহান আলী (রঃ) এর নির্মিত অপূর্ব কারুকার্য খচিত “ষাট গম্ভুজ মসজিদ” ছয় শতাব্দীরও অধিক কালের পুরাতন মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে! ঐতিহ্যবাহী মসজিদের নির্মাণশৈলী আর সৌন্দর্য নজর কাড়ে সবার। আধুনিক স্থাপত্যকে হার মানাচ্ছে প্রাচীন সৌন্দর্যমণ্ডিত ষাট গম্বুজ মসজিদ। তাই মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ মসজিদটি দেখতে আসেন। স্থাপত্য কৌশলে লাল পোড়া মাটির ওপর লতাপাতার অলংকরণে মধ্য যুগীয় স্থাপত্য শিল্পে মসজিদ এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাগেরহাট জেলার উপকূলে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনে খান জাহান আলী নামে এক সাধু একটি মুসলিম উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে একটি সমৃদ্ধ নগরীতে সাধু সংঘ সম্পর্কে প্রচার করেছিলেন, তত দিনে খাঁন জাহান আলী এই শহরটি এক ডজনেরও বেশি মসজিদ দিয়ে সজ্জিত করেছিলেন। ধারণা করা হয় তিনি ১৫শ শতাব্দীতে শৈ-গুম্বাদ মসজিদ নামে পরিচিত এই মসজিদটি বহু বছর ধরে বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করেছিলেন।


প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৩৩ সালে ব্রিটিশরা এবং পরে পাকিস্তান সরকার এই মসজিদটি প্রথমে মেরামত করেছিল। ২০১৪ সালে দক্ষিণ এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এটি আবার মেরামত করা হয়েছিল এবং বাগেরহাটের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৫ সালে মসজিদটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে পরিণত হয়েছিল।

ষাটগম্বুজ মসজিদের নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, সংস্কৃত শব্দসাত ফারসি শব্দছাদএর উপর গম্বুজ থাকায় এটিছাদগম্বুজথেকে ষাটগম্বুজ হয়েছে। আবার অনেকের মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ছয়টি সারিতে ১০টি করে মোট ৬০টি পাথরের খাম্বার উপর মসজিদের ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ।


আবার কারও মতে মসজিদটির ছাদ সমতল নয়। এটি গুম্বজ আকৃতির। অর্থাৎ ছাদে গুম্বজ। যার থেকে মসজিদটিছাদগুম্বুজনামে পরিচিতি লাভ করে। পরে কথ্যরূপেষাটগম্বুজনাম হয়েছে। জনশ্রুতি আছে যে, হযরত খান জাহান আলী (রহঃ) ষাট-গম্বুজ মসজিদ নির্মাণের জন্য সমূদয় পাথর চট্টগ্রাম আবার কারও মতে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। পুরো মসজিদ তৈরির মূল উপাদান চুন, সুরকি, কালোপাথর ছোট ইট। এই মসজিদের স্থাপত্যকলার সঙ্গে মধ্য এশিয়ার তুঘলক (তুরস্ক) স্থাপত্য শৈলীর মিল রয়েছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

 

রমজান মাসে বিপুলসংখ্যক মুসল্লি ইবাদত-বন্দেগির উদ্দেশ্যে মসজিদে আগমন করে থাকেন। দেশের অন্যতম একটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ বেশ প্রসিদ্ধ। সারা বছর এখানে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও শুক্রবার জু’মার নামাজে প্রচুর ধর্মপরায়ন মানুষের সমাগম ঘটে ষাট গম্ভুজ মসজিদে। মসজিদের মধ্যে ১৫শথেকে ১৮শলোক একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। এছাড়া বাইরেও পড়েন অনেকে। মসজিদ, জাদুঘরে ঘোড়া দীঘিতে ঘুরতে কিছু টাকা ফি লাগে। তবে আজান থেকে নামাজের সময় পর্যন্ত উত্তর পাশের একটি গেট খোলা থাকে। সেখান থেকে মুসল্লিরা নামাজের জন্য আসেন। তাদের প্রবেশ ফি লাগে না।

এই মসজিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে নির্মিত ক্ষুদ্র প্রবেশপথ। এটি উত্তর ভারতের কিছু মসজিদে দেখা যায়, তবে বাংলায় অপ্রচলিত। এই রীতিটি সম্ভবত আদি মুসলিম স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত মসজিদ থেকে ধার করা হয়েছে। আদি মুসলিম স্থাপত্যে মসজিদ পশ্চাতের এই প্রবেশপথটি ব্যবহূত হতো খলিফা, গভর্নর বা ইমাম কর্তৃক। তাই এটি খুব অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, এই পথটি ব্যবহূত হতো খলিফাতাবাদের শাসক খান জাহান কর্তৃক, যার বাসস্থান মসজিদের উত্তর দিকে সামান্য দূরত্বেই অবস্থিত ছিল। উল্লিখিত ইট নির্মিত প্লাটফর্ম দুটির মধ্যে কেন্দ্রীয় মিহরাবের নিকটবর্তীটি সম্ভবত খান জাহান কর্তৃক প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য নির্মিত হয়েছিল। আর পূর্ব দিকের একটি প্রবেশপথের নিকটবর্তী স্থানে নির্মিত অপরটি জনগণ বা ছাত্রদের মাঝে ইসলাম সম্পর্কিত বাণী প্রচারের জন্য ধর্মীয় গুরু কর্তৃক ব্যবহূত হতো। তাই দেখা যাচ্ছে যে ষাটগম্বুজ মসজিদটি তিনটি কাজে ব্যবহূত হতো- উপাসনামূলক সমাবেশ হিসেবে, আদি মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত সংসদ ভবন হিসেবে এবং পারস্যের আর্দিস্তানের ইসপাহান জামি বা মসজিদ--জামি মাদ্রাসা হিসেবে।

ষাটগম্বুজ মসজিদের সৌন্দর্য ভ্রমণ পিপাসুদের মুগ্ধ করে আসছে। ১৫ শতকের দিকে খান জাহান (রহ.) অতুলনীয় নকশায় মসজিদটি স্থাপন করেছেন। সেই আমলে এত নান্দনিক নির্মাণ শৈলী যা দেখে আমরা বর্তমান প্রজন্ম পর্যন্ত অবাক হয়ে আসছি আধুনিক স্থাপত্যকে হার মানাচ্ছে ষাট গম্বুজ মসজিদ।



 

 

Previous Post Next Post
atOptions = { 'key' : 'ff715ba50c059c742bfea5af35b4aa55', 'format' : 'iframe', 'height' : 50, 'width' : 320, 'params' : {} };