ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার এক অমর কীর্তি- “হার্ডিঞ্জ ব্রীজ”, পাকশী, পাবনা, বাংলাদেশ।

 

হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ইতিহাস-History of Hardinge Bridge

old hardinge bridge 

বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় রেলওয়ে ব্রীজ হচ্ছে হাডিঞ্জ ব্রীজ। এই ব্রীজ পাবনা জেলার পাকশীর গোড়া থেকে শুরু হয়ে পদ্মার ওপর দিয়ে ওপারে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারার মাথায় গিয়ে ঠেকেছে। বাংলার মার্জিত ইতিহাসে খ্যাত তথা উপমহাদেশের যোগাযোগের ইতিহাসে এক অপূর্ব সৃষ্টি। এর নির্মাণ ইতিহাস জানতে দেশ-বিদেশের অনেকেই আগ্রহী। বর্তমান জগতে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের চেয়েও দীর্ঘতম ব্রীজ রয়েছে। তা থাকলেও এ ব্রীজটি আজও অপ্রতিদ্বন্দিভাবে পৃথীবির বুকে বিখ্যাত একমাত্র পাকশী অবস্থিত হার্ডিঞ্জ ব্রীজ।

শ্যামলী বাংলার রূপসী পদ্মা নদীর এক তীরে ছিল সাঁড়াঘাট, অপর পাড়ে ভেড়ামারা দামুকদিয়া রায়টা ঘাট। মাঝখানে প্রশসত্ম পদ্মা তার ওপর উপমহাদেশের দীর্ঘতম রেলওয়ে ব্রীজ। এরই দক্ষিণ পার্শ্বে লালন শাহ্‌ সেতু।

হার্ডিঞ্জ ব্রীজ তৈরির ইতিহাস:

ফেরি সার্ভিস চালু:
asfiazad_1350179390_7-Loading_Wagons_on_Flats,_Sara_Ferry 

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সাঁড়াঘাট ছিল কলকাতার সাথে উত্তরবঙ্গ, শিলিগুড়ি, আসামের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। ১৮৭৮ সালে সাঁড়া থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হলে সাঁড়াঘাট বৃহৎ এবং কর্মচঞ্চল নৌবন্দরে পরিণত হয়। সাঁড়া বন্দরে তখন ১৬টি ঘাট ছিল।  সাঁড়া থেকে শিলিগুড়ি মিটার গেজ রেলপথ স্থাপিত হওয়ার পর ভেড়ামারা থানার দামুকদিয়া-রায়টা ও সাড়াঘাটের মধ্যে চালু হয় নদী পারাপারের জন্য ফেরি সার্ভিস। তারপর উত্তর বঙ্গের যতো তরিতরকারী, মাছ, ডিম, মাংস, চাল, ডাল প্রভৃতি কলকাতায় দ্রুত পৌছানোর ব্যবস্থা ছিল।

ব্রীজ তৈরীর প্রস্তাব:

saraghat2 

উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে পদ্মা নদীর পূর্ব তীরে সাড়াঘাট ছিল দেশের অন্যতম বৃহৎ নদী বন্দর। এ সময়ে দেশী-বিদেশী বড় বড় স্টীমার লঞ্চ, বার্জ, মহাজনী নৌকা ইত্যাদি ভিড়তো সাঁড়া বন্দরের ১৬টি ঘাটে। বিদেশী পর্যটক তথা সর্ব সাধারণের দার্জ্জিলিং ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে যাতায়াতের সুবিধা হয়েছে আর সে কারণে তখন কাঠিহার থেকে রেলপথ আমিন গাঁ আমনুরা পর্যনত্ম সমপ্রসারিত হয়েছিল যাত্রী ও মালামাল বহুল অংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় অবিভক্ত ভারত সরকার তখন পদ্মা নদীর ওপর ব্রীজ তৈরীর প্রসত্মাব পেশ করেন।

Hilsa_Fishing_Boats_DeGolyer Library, Southern Methodist University 

পদ্মা নদী তখন ছিলো ভিষন খরস্রোতা। ১৮৮৯ সালে ব্রীজ তৈরীর প্রসত্মাবের ওপর ভিত্তি করে ১৯০২ সাল থেকে ১৯০৫ সাল ধরে ম্যাচ এফ জে ইসিপ্রং একটি বিসত্মারিত প্রতিবেদন তৈরী করেন। সাঁড়া ঘাটের দক্ষিণে ব্রীজ স্থাপনের সম্ভাব্যতার তথ্য সরকারের কাছে দেয়া হয়েছিল। সে মোতাবেক ১৯০৭ সালে পাকশীতে ব্রীজ নির্মাণের পরিকল্পনা চুড়ানত্ম করা হয়েছিল।

 

ব্রীজের মূল নকশা প্রণয়ন:

designer 

১৯০৮ সালে ব্রীজ নির্মাণের মঞ্জুরী লাভের পর ইঞ্জিনিয়ার ইনচীফ হিসাবে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন রবার্ট উইলিয়াম গেইলস। ব্রীজের মূল নকশা প্রণয়ন করেন স্যার এস এম বেনডেলেগ। ব্রীজটির প্রসত্মাবের ওপর প্রথম প্রকল্প প্রণয়ন করেন স্যার ফ্রান্সিস সপ্রীং। ব্রীজ ঠিকাদার ছিলেন ব্রেইথ ওয়াইট এন্ড কার্ক।

গাইড ব্যাংক নির্মাণ:

View_of_Left_Guide_Bank_From_Top_of_Girder._(22553227967) (1) 

১৯০৯ সালে পদ্মার ওপর দিয়ে ব্রীজ নির্মাণের জরিপ কাজ শুরু হয়। ১৯১০ ও ১১ সালে প্রথম কাজের মৌসুম শুরু হলে ভয়াল পদ্মার দুই তীরে ব্রীজরক্ষী বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পদ্মার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এই দুরূহ কাজ করতে গিয়ে বিশ্বে প্রথম রিভার ট্রেনিং ও গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হয় পদ্মার উভয় পাড়ে। প্রায় ৮ কিলোমিটার উজান থেকে গাইড ব্যাংক বেঁধে এনে ১৯১২ সালে শুরু হয় রেল সেতুর কাজ। ১৯১২ সালে ব্রীজের গাইড ব্যাংক নির্মাণ শুরু হয় উজান থেকে ৪/৫ মাইল পর্যন্ত।

ব্রীজের স্থান পরিবর্তন: ঐ সময় প্রথমে ব্রীজের কাজ শুরু হয়েছিল বর্তমান ব্রীজ যেখানে অবস্থিত সেখান থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দক্ষিণে জিকে সেচ প্রকল্পের সামনে। এখানে প্রাথমিকভাবে ব্রীজের বেশ কিছু কাজ হওয়ার পর অজ্ঞাত কারণে তা স্থান পরিবর্তন করে উত্তর দিকে পুনরায় ব্রীজ নির্মাণ কাজ শুরু করে যেখানে বর্তমান ব্রীজটি নির্মিত রয়েছে

কূপ খনন শুরু:

এরপর নরম পলিমাটিতে স্প্যান নির্মাণ ছিল আরেকটি দুরূহ কাজ। রিভার বেড বা নদী শয্যার নিচে ১৯০ থেকে ১৬০ ফুট গভীরতায় কূপ খনন করে স্থাপিত হয় স্প্যান। ১৯১২ সালে খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মা নদীর স্রোতকে পরাজিত করে ৫টি কূপ খনন করা হয়। ১৯১৩ সালে আরো ৭টি কূপ খনন করা হয়।

Launching_Curb_(22038846408)No._15_Curb_While_Pumping_Water_Into_Wooden_Pontoons_(21992308034)Suction_Dredging_Pump_(21990824994)Concreting_No._15_Caisson_(22412744388)No._2_Well_Sinking_(22587583836)No._15_Pier_Removal_of_Staging_(22351290641)

স্প্যান তৈরী হয়ঃ কূপ খনন কাজ শেষ হলে পরে মোট ১৫টি স্প্যান গড়ে তোলা হয়। যার প্রতিটির বিয়ারিংদ্বয়ের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৩শ ৪৫ ফুট দেড় ইঞ্চি এবং উচ্চতা ছিলো ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১ হাজার ২শ ৫০ টন।

  

রেল লাইনসহ ১ হাজার ৩শ টন, ব্রীজটিতে মোট ১৫টি স্প্যান ছাড়াও দুই পাড়ে ৭৫ করে ৩টি অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান রয়েছে। এদের প্রতি দু’টি বিয়ারিংদ্বয়ের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট। এভাবে ব্রীজটির মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় মোট ৫ হাজার ৮শ ৯৪ ফুট, অর্থা্যৎ ১ মাইলের কিছু বেশি ব্রীজটি।

 


হার্ডিঞ্জ ব্রীজ নামকরণ এবং শুভ উদ্বোধন:
 
১৯১৫ সালে ব্রীজ নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং ঐ সালে ১ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি মালবাহী বগি নিয়ে একটি ইঞ্জিন সেতু অতিক্রম করে। জানা গেছে, সোনা মিয়া নামে এক চালক প্রথম ইঞ্জিন নিয়ে পাড়ি দেন সেতু।

  Ceremony of Removing last service GirderFirst_Train_on_Up_Line._(22982717151) 

দু’মাস পরেই ৪ মার্চ ১৯১৫ সালে ব্রীজের ওপর ডবল লাইন দিয়ে যাত্রীবাহি গাড়ি ট্রেন চলাচলের জন্য উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হাডিঞ্জ। তার নামানুসার ব্রীজটির নামকরণ হয় হার্ডিঞ্জ ব্রীজ। পাকশী হাডিঞ্জ ব্রীজ নামে পরিচিত। তারপর থেকেই রেল গাড়ি ঝমঝম শব্দ করে পারাপার হতে থাকে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ওপর দিয়ে। পরে এই ব্রীজের সাথে একটি দীর্ঘ ফুটপাত জুড়ে দেয়া হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রবীণদের কাছে ‘সাড়াপুল’। একসময় এ সাড়াপুল ছিলো এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন।

 Opening_Ceremony._DeGolyer Library, Southern Methodist University

কত শ্রমিক কাজ করেছে:
১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রকল্পটিতে কর্মী সংখ্যা ছিলো মোট ২৪ হাজার ৪শ শ্রমিকের দীর্ঘ ৫ বছর অক্লানত্ম পরিশ্রমের পর ১৯১৫ সালে ব্রীজের কাজ শেষ বলে রেল বিভাগ সূত্রে জানা যায়।

কত কিছু লেগেছেঃ
ব্রীজ নির্মাণের ব্রীজ রক্ষা বাঁধের জন্য মাটির কাজের পরিমাণ দুই পার্শ্বের লাইনের ১৬ কোটি ঘনফুট। মোট ইটের গাথুনির কাজ হয় ২ লাখ ৯৯ হাজার টন। মোট ইস্পাত ব্যবহৃত হয় ৩০ লাখ টন। মোট সিমেন্ট ব্যবহৃত হয় ১ লাখ ৭০ হাজার ড্রাম। কিলডসিমেন্ট লাগানো হয় ১২ লাখ ড্রাম।

কত টাকা ব্যয়ঃ
তৎকালীন হিসেবে ব্রীজটি তৈরী করতে ব্যয় হয় অনেক টাকা। স্প্যানের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ৬ হাজার ৭শ ৯৬ টাকা। ল্যান্ড স্প্যান স্থাপনের জন্য ৫ লাখ ১৯ হাজার ৮শ ৪৯ টাকা। নদীর গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩শ ৪৬ টাকা। দুই পাশের রেল লাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১শ ৭৩ টাকা। ব্রীজটি নির্মাণ করতে তৎকালীন টাকা সর্বমোট ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১শ ৬৪ টাকা খরচ হয় ব্রীজ পুনঃ নির্মাণ ব্যয়। এখনকার সময় সীমিত টাকা হলেও ঐ সময় টাকার অনেক মান ছিল এ তথ্য রেলের পাকশী ডিবিশন থেকে জানা গেছে।

যে কারণে ব্রীজটি বিখ্যাতঃ
উলে­খিত ক’টি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রকল্পটির ব্যাপক বড় ও বিখ্যাত তার বিশাল পরিচয় বহন করে। বর্তমান জগতে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের চেয়েও লম্ব সেতু অনেক আছে। কিন্তু দু’টি কারণে প্রৌকশল জগতে এ ব্রীজটি অপ্রতিদ্বন্দীভাবে বিখ্যাত। প্রথম কারণ হচ্ছে এ ব্রীজের ভিত গভীরতম পানির সর্বনিম্ন সীমা থেকে ১৬০ ফুট বা ১৯২ এমএসএল মার্লির নিচে। উলে­খ্য, ১৫ নম্বর ব্রীজ সত্মম্ভের কুয়া স্থাপিত হয়েছে পানি নিম্নসীমা থেকে ১শ ৫৯ দশমিক ৬০ ফুট নিচে এবং সর্বোচ্চ সীমা থেকে ১শ ৯০ দশমিক ৬০ ফুট অর্থ্যাৎ সমুদ্রের গড় উচ্চতা থেকে ১শ ৪০ ফুট নীচে। সে সময় পৃথীবিতে এ ধরনের ভিত্তির মধ্যেই এটাই ছিল গভিরতম। বাদ বাকি ১৪টি কুয়া বসানো হয়েছে ১৫০ ফুট মাটির নিচে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এ ব্রীজের জন্য রিভার ট্রেনিং ব্যবস্থা আছে তাও পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। গেইলস সাহেব এ ব্রীজ নির্মাণের অপূর্ব সাফল্যের পুরস্কার স্বরূপ স্যার উপাধিতে ভূষিত হন।

মজার কান্ডঃ

Footpath of Bridge 

অজপাড়া গাঁ থেকে একবার একদল লোক এসেছিলো পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রীজ দেখতে। এতবড় ব্রীজ তারা জীবনেও কোন দিন দেখেনি। ভাবতেই পারে না কতো বড় কান্ড ঘটে গেছে পদ্মার ওপর দিয়ে। একজন লোক অবাক চোখে হার্ডিঞ্জ ব্রীজটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো দ্যাখতো কত বড় ব্রীজ মনে কর ৫শ টাকার নুয়াই নাগছে। ৫শ টাকার বেশি কল্পনা করারও ক্ষমতা ছিল না লোকগুলোর। তাদের কথা লোহার সঠিক হিসেব না পাওয়া গেলেও ব্রীজটি যে আসলেও মসত্ম বড়, সেটা বোঝা যায়।  বর্তমান হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচে আজ আর পদ্মার সেই গভীরতা নেই। পদ্মার বুক জুড়ে জেগে উঠেছে ছোট বড় ধু-ধু বালুর চর। নেই হার্ডিঞ্জ ব্রীজের যত্ন। নিয়মিত রং না করার কারণে ব্রীজটিতে মরিচা ধরা শুরু করেছে। তবুও পাকশীর হাডিঞ্জ ব্রীজ কালের স্বাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধু-ধু বালুর চরের ওপরে।

সংকলন: ইঞ্জিনিয়ার মো: সাইফুল্লাহ-আল-রাশেদী (সজীব),
প্রকৌশলী-গ্রামীনফোন, রুয়েট-৯৯, চন্দ্রপ্রভা-৯৭।
Previous Post Next Post
atOptions = { 'key' : 'ff715ba50c059c742bfea5af35b4aa55', 'format' : 'iframe', 'height' : 50, 'width' : 320, 'params' : {} };