মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি সেক্টর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

 

মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি সেক্টর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি সেক্টর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের পর প্রবাসী সরকার কাজ শুরু করে। ১৯ এপ্রিল এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আবদুল মান্নানকে মন্ত্রী পদ-মর্যাদায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২৪ মে দুটি রেকর্ডার মেশিন এবং মাত্র ১টি মাইক্রোফোন দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কলকাতার ২৫ মাইল দূরে ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রে কোরআন তেলাওয়াত ও বক্তৃতার মাত্র ১০ মিনিটের প্রচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতারের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্যান্ডে সেকেন্ড প্রতি ৮৩০ কিলোসাইকেলে প্রতিধ্বনিত হয় এটি। শুরুতে কেন্দ্রটিকে বেশ সমস্যার দিয়ে যেতে হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অত্যধিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘চরমপত্র’। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ, রণাঙ্গনের সাফল্য কাহিনি, সংবাদ বুলেটিন, ধর্মীয় কথিকা, বজ্রকণ্ঠ, নাটক, সাহিত্য আসরসহ আরও কিছু অনুষ্ঠান পরিধি বাড়তে বাড়তে দৈনিক ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত নিয়মিত প্রচার হতো। আর এই বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠ সৈনিক ছিলাম আমি। যার জন্য আজ নিজেকে গর্বিত মনে করি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যতগুলো সেক্টর যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তার মধ্যে আরেকটি সেক্টর ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। কারণ এই বেতার কেন্দ্রটি যদিও কোনো সেক্টরের আওতায় ছিল না তবুও কেন্দ্রটি একটি সেক্টরের মতোই কাজ করেছে। যুদ্ধ কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে পাক হানাদারকে পর্যুদস্ত করছে, কোন ব্রিজ বা কালভার্ট উড়িয়ে দিচ্ছে, কোন এলাকা দখল হয়েছে তার সবই জানা সম্ভব ছিল এই বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে। শুধু যে এসব খবর তারা পেত তা নয় একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কর্মীদের, গেরিলাদের ও আপামর জনসাধারণকে আশার আলো দেখিয়ে যাচ্ছিল এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

এই বেতার কেন্দ্রে তখন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যথার্থ না থাকলেও কেন্দ্রে প্রত্যেকের উদ্যমতা ছিল। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটির দোতলার ছোট কক্ষটিতে (যেখানে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন) দুটি ভাঙা টেপরেকর্ডার, সীমিতসংখ্যক বাদ্যযন্ত্র, কতিপয় যন্ত্রশিল্পী, চাদর টাঙানো রেকর্ডিং রুমেই চলে রেকর্ডিং কাজ। দুটি কক্ষে গাদাগাদি করে প্রায় ৭০ জন রাত্রী যাপন করতাম। এই বেতার কেন্দ্রই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।

৯ মাস সম্মুখ মুক্তিযুদ্ধে দেশের অজস্র বীর সন্তান জীবন অকাতরে করেছেন দান। অবিস্মরণীয় তাদের এ অবদান। দেশমাতৃকার স্বাধীনতায় জীবনকে তুচ্ছ ভেবে শত্রুর মোকাবিলায় তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। এমনো কিছু মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা অস্ত্র হাতে তুলে নেননি কিন্তু তাদের কণ্ঠ, তাদের আওয়াজ মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের মুক্তি সেনানীদেরকে, আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সফলতায় ভূমিকা রেখেছেন। দেশকে যারা স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন তারা হলেন স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দ সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা।

বাংলার পবিত্র মাটি থেকে পাকিস্তানি জল্লাদবাহিনী বিতাড়িত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি যে যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সাহস যুগিয়েছে; যুগিয়েছে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে অনুপ্রেরণা এবং হানাদার বাহিনীকে সর্বক্ষণ রেখেছে ভীতসন্ত্রস্ত তা হলো ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’। আর এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে পাক সরকারের দখলকৃত এলাকার ছয়টি বেতার কেন্দ্র থেকে অবিরাম প্রচন্ডভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে মিথ্যাচার এবং অপপ্রচাচালানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জবাব দেওয়া হয়েছে একমাত্র বেতার কেন্দ্র থেকে। মুক্তিযুদ্ধবিরুদ্ধ অপপ্রচারের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল শক্তিশালী একটি প্ল্যাটফরম। প্রয়াত কামাল লোহানী বলেন, ‘আমাদের জন্য বেতার ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধক্ষেত্র, যার মাধ্যমে আমরা জনগণের সাহস বাড়াতে সহায়তা করেছিলাম।’

প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র সংগঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বেতারের ১০ জন নিবেদিত কর্মী (দুজন বেতার কর্মী ছিলেন না), স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, জনগণ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহযোগিতায়। এই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ১০ জন সার্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন সর্বজনাব বেলাল মোহাম্মদ (উক্ত বেতারের তৎকালীন নিজস্ব শিল্পী), আবদুল কাশেম সন্দ্বিপ (ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল), সৈয়দ আবদুল শাকের (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন বেতার প্রকৌশলী), আবদুল্লাহ আল ফারুক (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), মোস্তফা আনোয়ার (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুর হোসেন (তৎকালীন টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট), আমিনুর রহমান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট), শারফজ্জামান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর) এবং কাজী হাবিব উদ্দিন (ইনি বেতারকর্মী ছিলেন না), স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যুদ্ধে যাব। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান করব। ২৫ মার্চের কালো রাত্রির পর থেকেই চেষ্টা করছিলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য, প্রতিদিনই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। ইতোমধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন শুরু হয়েছে। ১৯৭১ সালের জুন মাস মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তখনই কোনো এক ভোররাত, ঘুম থেকে উঠলাম। ঘরে মা, বাবা, ভাই-বোন, খাটে মশারি টাঙানো। পরনের কাপড়েই বেরিয়ে গেলাম, ঘরের কাউকে কিছু না বলে।

লেখাঃ প্রফেসর ডক্টর অরুপরতন চোধুরী।

সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন।

 

Previous Post Next Post
atOptions = { 'key' : 'ff715ba50c059c742bfea5af35b4aa55', 'format' : 'iframe', 'height' : 50, 'width' : 320, 'params' : {} };